আত্মহত্যা সমাধান নয়

suicide

“শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে;/ কাল রাতের ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/ যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হ’লো তার সাধ;”

জীবনানন্দ কী উদ্দেশ্যে কার কথা ভেবে কেনো লিখেছেন জানা নেই। জীবনানন্দও তিমিরে হারিয়েছেন ট্রাম দুর্ঘটনায়, কেউ কেউ অন্যভাবে ব্যখ্যা করবার চেষ্টা করেন। আপনি জানেন কী প্রতিটি লাশকাটা ঘরের ৮০ ভাগ মৃতদেহই আত্মহত্যার? ১৮-২৪ বছরের মানুষের মৃত্যুর কারণ বিচারে প্রথম কারণ আত্মহত্যা, তারপর সড়ক দুর্ঘটনা তারপর অন্যান্য।

আপনি জানেন কি এই গোলকধাধার বিশ্বে প্রতিবছর ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যাকে বেছে নিচ্ছে বিভিন্ন কারণে? আর আত্মহত্যার সংখ্যার বিচারে বিভিন্ন সূত্রমতে বাংলাদেশ দশম। আপনি এ লেখাটি পড়তে যতটুকু সময় নিয়েছেন সেই সময়ে অর্থাৎ প্রতি পাচ সেকেন্ডে বিশ্বের একজন মানুষ সিনেমাটিক ভাবে ভাবছে “হে মহাজীবন মুক্তি দাও” কিংবা জীবন এর প্রতি তীব্র বিরক্ত কিংবা আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে।

অশিক্ষিত কিংবা দরিদ্রদের চেয়ে শিক্ষিত বিত্তশালীদের মাঝে এর প্রবণতা বেড়েছে। সবচেয়ে মোটিভেশনাল বক্তব্য প্রদানকারী ব্যক্তিত্ব টিকেও দেখা যায় আত্মহত্যার কারণে লাশকাটা ঘরে। গতকাল যে স্বপ্ন দেখাত তাকেও দেখা যায় জীবন এর কাছে হার মেনে নিতে।

আত্মহত্যা কে “সামাজিক ব্যধি” আর “মহাপাপ” বলে আমরা সব দায়িত্ব শেষ করি। আমরা কারণ ও জানি আধুনিক যুগের মানুষ গুলো ক্যানো আত্মহত্যা বেছে নেয়।

সেগুলোর প্রতিকার প্রতিরোধ ও আছে। কিছু হয়তো মানুষের নাগালের বাইরেও।…

“যেই মানুষ টি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়ে মাথা তুলে দাড়িয়েছিল, আবার সেই মানুষটিই সামান্য বাজিতে হেরে আত্মহত্যা করে”। আবার আত্মহত্যার চেষ্টাকারী মানুষ টিও হতে পারে নিজেকে মনস্তাত্তিক ভাবে ঠিক করে ম্যাক্সিম গোর্কির মতো কিংবদন্তির।

মানুষের কষ্টের পরিমাণ বিচিত্র, মানুষ ভেদে ভিন্ন। হাজার কারণ এর প্রতিকার করেও লাভ নেই যদি না মানসিক স্থিরতা আসে। একটি বেড়ালের মৃত্যুতে কারো মরে যেতে ইচ্ছে করে,কেউ কেউ প্রেমিকার বিয়ের দিন পিএইচডি করতে যায়… সবার মানসিক শক্তি এক নয়।

‘মানসিক শক্তি, মানসিক স্থিরতা’ বৃদ্ধি করতে পরিবার বন্ধুকে এগিয়ে আসতে হবে আগে। সবাই শুনতে চাই “আপনি ভালো আছেন তো? কেউ শুনতে চাইনা “আপনার কোনো সমস্যা যাচ্ছে কিনা?”

নিজের সমস্যা অপর কে বলতে হবে এর বিকল্প নেই। তা শুধু মানুষ ই নয়, জড় কিংবা প্রাণী হলেও দোষ নেই। কে জানে আপনি গাছ কে বললেন,বাচতে চাইনা। গাছ এমন বাতাস প্রবাহিত করল,আপনি ভাবলেন গাছ সুন্দর, জীবন সুন্দর। আর বাচতে হলে সবসময় সুন্দরের পুজারী হতে হবে; তাইবা কে আবিষ্কার করল?

তবে আগে আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী কে আপনার সমস্যা জানান। নিজেও অন্যের শুভাকাঙ্ক্ষী হোন। যিনি প্রকাশ করতে চান না তাকে প্রকাশের জায়গা দিতে হবে। যিনি প্রকাশ করতে চান তাকে সময় দিতে হবে; প্রয়োজনে ঝাপিয়ে পড়তে হবে তার সমস্যা সমাধানে।

দেশের গণমাধ্যমে যত সুন্দর করে আত্মহত্যার কারণ আর উপায় গুলো অভিনয়ের মাধ্যমে দেখানো হয়,তা প্রতিকার বা মানসিক শক্তি বা স্থিরতা বাড়ানোর কৌশল নিয়ে গবেষণা বা গণমাধ্যমে প্রচার তেমন নেই বললেই চলে।

১০ সেপ্টেম্বর বিশ্বজুড়েই পালিত হয় বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য ছিল-“কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরি কর।” ২০০৪ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ব্যপারে কাজ করে আসছে। কিন্তু মানসিক স্থিরতা বা শক্তি ধৈর্য বাড়ানোর কৌশল নিয়ে গবেষণা চেষ্টার জায়গা টা কম ই থেকে যাচ্ছে।

রেল লাইনে সবাই হারিয়ে যেতে যায়না,সেখানে সৌন্দর্য আছে,কষ্ট ঘাম ধৈর্য আছে;বেচে থাকার মতো দুর্দান্ত প্রতাপে চলন্ত রেল আছে,কিংবা পঙ্গু ভিক্ষুক এবং কুলির বেচে থাকার সংগ্রাম ও আছে, তা জীবনীশক্তি ই দিতে পারার জন্য যথেষ্ট হবে যদি মানসিক স্থিরতা থাকে। কেস স্টাডি:অতি তুচ্ছ কারণে ও আত্মহত্যার সব পথ সব উপায় জেনে ফেলছে সব বয়সের মানুষ,তা প্রয়োগ ও করছে,কিন্তু বাচার উপায় নিয়ে প্রচার ও স্টাডি নেই। আসলেই যার যার দুঃখ তার তার কাছে অনেক বড়। কেউ সামান্য বকা খেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়,কারো কারো জুতাপেটাতেও ও কষ্ট লাগেনা।

আমাদের দেশের চলচ্চিত্র এবং নাটকে আত্মহত্যার যতগুলো পদ্ধতি শেখানো হয়েছে, তার সবগুলোই প্রয়োগ করা মানুষের শেখা হয়ে গেছে। চলচ্চিত্র নাট্যচিত্রে পাঠ্যক্রমে অবশ্যই জীবনের মূল্য এবং বিষন্নতা হতাশায় তা কীভাবে মুখোমুখি হতে হবে তা শেখানোর চর্চা থাকা উচিৎ।

চরম কঠিন মানুষ টির ও আত্মহত্যার খবর আসে….হয়তো সে ও আর নিজের সাথে পেরে ওঠেনি। তাই বাচার জন্য যুদ্ধ আছে;বাচবার শিক্ষাটুকু নেই।এর চর্চা সিলেবাসে থাকলেও প্রয়োগ সবাইকে করতে হবে।

★ধর্মীয় জ্ঞান। ★ধৈর্য ★সুশিক্ষা ★সু সংগ ★সামাজিক পুনর্বাসন। হয়তো এভাবে ৯৫% আত্মহত্যা ফেরানো সম্ভব। আত্মহত্যার উপকরণ সব সহজলভ্য। কেনো বাচার সব উপকরণ হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও সঠিক প্রয়োগ নেই? কারো পাশে না থাকুন।

অন্তত বলুন u are not alone…….

একে অন্যকে কাজে কথায় বলুন বোঝান u are not alone…….

গোমড়ামুখো বাচাল সবাইকেই বলুন u are not alone…….

আপনি আরেকজনের পাশে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে দাড়ান, সৃষ্টিকর্তাও আপনার পাশে থাকবেন। আপনার নিজেকে অন্তত একা করবেন না।

লেখক: ডা: কাজী একেএম রাসেল, আবাসিক মেডিকেল অফিসার, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ।

নিউজটি শেয়ার করুন
Scroll to Top