পদধুলি নেবার মত পবিত্র পা আজ বিরল

শিক্ষক

সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু: আমার স্কুলকালের শিক্ষকদের মধ্য হিরন্ময়দ্যুতিতে উজ্জ্বল, দেবতুল্য শিক্ষকরা দুএকজন বাদে আর কেউ বেঁচে নেই। ছবির এই মানুষটি আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। দেবতুল্য মানুষ। স্যার আজ বয়সজনিত অসুস্থতাসহ নানা রোগে বেশ কিছুদিন যাবত শয্যাশায়ী। পরমকরুণাময়ের কাছে তাঁর সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছি।

স্যারকে নিয়ে ২০১৫ সালে নিচের স্মৃতি কথাটি লিখেছিলাম। সময় হাতে থাকলে পড়তে পারেন।

দেবেন্দ্রনাথ রুদ্র, ‘রুদ্র বাবু’ নামেই চিনেন সবাই । আমার প্রিয় শিক্ষক। অসীম শ্রদ্ধার মানুষ। সেই স্কুলজীবনে অবাক বিস্ময়ে তাঁকে দেখতাম। আমি বড় হয়ে উঠেছি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একটি মহকুমা শহরে। ৪২/৪৩ বছর আগে এই শহরে স্কুলশিক্ষক বলতেই বুঝতাম পাজামা-পাঞ্জাবী, স্লিপার পড়া সাদামাঠা মানুষদের। আমাদের আইডল এই স্যার সেই সময়ে চকচকে পলিশ করা জুতো, ইস্ত্রি করা হাল ফ্যাসনের প্যাণ্ট-শার্ট ইন করে পড়ে , দৃষ্টিনন্দন স্টাইলে হেঁটে হেঁটে স্কুলের গেট, মাঠ, পেড়িয়ে চলে যেতেন টিচার্স রুমে। চুলের স্টাইলটাও ছিলো ব্যাকব্রাস করা, দেখবার মত । মুখে ক্ষর-জর্দা ছাড়া ছোট্ট একটু পানের দেখাও মিলতো মাঝে মাঝে। একটি দিনের জন্যও লুঙ্গি পড়া অবস্থায় তাঁকে শহরে দেখিনি।

ঈর্ষনীয় শুভ্রতায় পূর্ণ এবং পবিত্র স্বভাবের মানুষ, মানিকগঞ্জ মডেল হাইস্কুলের আমাদের অংকের শিক্ষক “রুদ্রবাবু স্যার”। তাঁর মত মেধাবী অংকের শিক্ষক সে সময়ে ছিল দুর্লভ, হয়তো আজও দুর্লভ । চমৎকার সরল কৌশলে বুঝিযে দিতে পারতেন জটিল সব অংক।

বরাবরই মেপে মেপে কথা বলতেন, তাও শুদ্ধ উচ্চারণে। স্যারের মত আমারও জীবন কাটছে এই শহরে। কম নয় আমারই অর্ধ শতাব্দীরও বেশী। একটি দিনের জন্যও স্যারকে কারও সাথে ঝগড়া করা তো দূরের কথা, উচ্চস্বরে তর্ক পর্যন্ত করতেও দেখিনি। তাঁর সম্পর্কে এই শহরে একটি দিনের জন্যও কেউ কোন মন্দ কথা বলেনি।

অসম্ভব সময়নিষ্ঠ মানুষ ছিলেন তিনি। স্যারকে স্কুল গেটে দেখলেই বুঝে যেতাম কটা বাজে। একদিন নয়, যতদিন স্কুলে ছিলাম ততদিনই ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে স্কুলে আসতে দেখেছি তাঁকে। ছাত্রদের ভালবাসতেন সন্তানের মত। বেত নিয়ে ক্লাসে আসতেন বটে কিন্তু কোনদিন তা ব্যবহার করতে দেখিনি। খুব রেগে গেলে বকা দিতেন,“রত্নের দল, ঝোড়-জঙ্গল থেকে এসেছে নাকি”। এর বেশী না ।

স্যার অবসরে গেছেন অনেক আগে। বয়স এখন সত্তর পেড়িয়েছে । এখনও মুগ্ধ হয়ে স্যারকে এই শহরে হাঁটতে দেখি, সেই চিরচেনা নান্দনিক স্টাইল। সুযোগ পেলে, সুযোগ করে নিয়ে আজও তাঁর পদধুলি নেই, মাথায় হাত রেখে প্রাণখুলে আশির্বাদ করেন মানিকগঞ্জ মডেল হাইস্কুলের স্বর্ণযুগের শিক্ষকদের পুরোধা, আমার পরম শ্রদ্ধার মানুষ দেবেন্দ্রনাথ রুদ্র।

স্যার পদধুলি নেবার মত শুভ্র মানুষ, পবিত্র পা এই শহরে আজ বিরল। আরও অজস্র বছর পদধুলি নিতে চাই স্যার, বঞ্চিত করবেন না।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

নিউজটি শেয়ার করুন
Scroll to Top