মানিকগঞ্জে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও শুরু হতে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা। তবে ঐহিত্যবাহী বিজয় মেলাটি এবার রূপ নিয়েছে বাণিজ্য মেলায়। উদযাপন কমিটি টাকার বিনিময়ে মেলাটিকে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হোক আজকের প্রজন্ম এই শ্লোগানকে সামনে রেখে ১৯৯১ সাল থেকে মানিকগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিজয় মেলা। প্রতিবছর ১৩ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ মুক্ত দিবসে ১৩ দিন ব্যাপী এই মেলাটি উদ্বোধন করা হতো। এবছর মেলা উদযাপন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন বীরমুক্তিযোদ্ধা মোমিন উদ্দিন খান ও সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন বীরমুক্তিযোদ্ধা ওবায়দুল ইসলাম ইয়াকুব। প্রতিবছর মেলা উদযাপন কমিটির উদ্যোগেই স্টল বরাদ্দ দেয়া হতো। তবে, গত দুই বছর ধরে মেলা পরিচালনা করছে ডিএম ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠান মেলার ডেকোরেশনসহ স্টল বরাদ্দের কাজও করছে। মেলায় শতাধিক দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। স্থানীয়রা কিছু দোকান পেলেও বেশিরভাগ দোকানই জেলার বাইরের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দোকানদার জানিয়েছেন, মেলা কমিটি যতদিন দোকান বরাদ্দ দিত তখন দোকানের রেট ছিল অনেক কম। দুই বছর ধরে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই দোকানের রেট বেড়েছে ৫ গুণ। মেলায় সর্বনিম্ন ২০ হাজার থেকে শুরু করে আড়াই লাখ টাকারও স্টল রয়েছে।
মানিকগঞ্জের কয়েকজন চটপটি ব্যবসায়ি বলেছেন, দুই বছর আগেও যে দোকান ৩৫০০ টাকায় মিলতো সেই দোকান এবছর তাদের নিতে হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার টাকায়। এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম বেশি তার ওপর দোকানের ভাড়া তুলতে গেলে তাদেরকে বেশি দামে খাবার বিক্রি করতে হবে। এতে করে বেচাকেনা অনেকটাই কমে যাবে।
তারা জানান, মেলায় ২০ হাজার টাকার নিচে কোন দোকানই মিলছে না। শুধু তাই নয় যে সকল দোকান ৩০/৪০ হাজার টাকায় আগে মিলতো সেগুলো এখন নিতে হচ্ছে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায়।
এখলাছ উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ি বলেন, গত ১৫ বছর ধরে বিজয় মেলায় তিনি ভাতের হোটেল করেন। দুই বছর আগেও দুই হাজার টাকা দিয়ে তিনি দোকান নিতেন। গতবার এই মেলায় তিনি ২৫ হাজার টাকায় দোকান নিয়েছিলেন। এবছরও কমিটি তার কাছ থেকে এমন দামই নিবেন।
মাসুদ নামের এক ব্যবসায়ি জানান, দুই বছর ধরে মেলায় অরাজকতা চলছে। বিজয় মেলার যে চেহারা ছিল সেটি এখন আর নাই। এটি এখন বাণিজ্য মেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। মেলায় অতিরিক্ত দোকান ভাড়ার কারণে বেশি দামেই জিনিস বিক্রি করতে হবে। ৫ টাকার জিনিস ক্রেতাদের কিনতে হবে ২৫/৩০ টাকায়। এতে করে আমাদের মানিকগঞ্জের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিষয়টি প্রশাসনের দেখা উচিত।
মামুন মিয়া নামের এক ব্যক্তি জানান, ছোট বেলা থেকেই মেলাতে বধ্যভূমির একটি আয়োজন থাকতো। মাটিরমূর্তি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ইতিহাস মেলাতে বড় করে থাকতো।গত দুই বছর ধরে সেই জায়গায় দোকান বানিয়ে ভাড়া দেয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় এটি মোটেও কাম্য নয়।
ভোক্তাদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এবি এম শামছুন নবী তুলিপ বলেন, মানিকগঞ্জের এই বিজয় মেলার একটা ঐতিহ্য ছিল। সেই ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ইদানীং ইভেন্টের কাছে বেশি দামে মেলা ভাড়া দেয়া হচ্ছে। তাতে করে ভোক্তাদের কাছ থেকেই তো পন্য বেশি দামে বিক্রি করবে ওইসব ব্যবসায়ীরা। একদিকে যেমন মানিকগঞ্জের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি ভোক্তা পর্যায়েও বেশি দামে পন্য কিনে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই আমি চাই ইভেন্টের কাছে মেলা বিক্রি না করে মানিকগঞ্জের ব্যবসায়ীদেরকে নিয়ে পুরনো সেই ঐতিহ্যের বিজয় মেলা ফিরিয়ে আনা হোক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় ব্যবসায়ি বলেন, ৭০ লাখ টাকা দিয়ে তিনি মেলাটি কেনার জন্য মেলা কমিটিকে অনুরোধ করেছিলেন। কমিটি তাকে না দিয়ে ডিএম ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে মেলার দায়িত্ব দিয়েছে। শুনেছি তাদের কাছ থেকে ৮০ লাখ টাকা নেয়া হবে।
মেলা পরিচালনার দায়িত্বে ডিএম ইন্টারন্যাশনাল এর কর্ণধার মোহাম্মদ গাজী সোহেল জানান, গতবছর এই মেলায় আমার অনেক টাকা লোকসান হয়েছে। তাই মেলা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনের প্রেক্ষিতে তারা এবছর আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি এ পর্যন্ত মেলায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা খরচ করেছি আরও ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা লাগবে মেলার কাজ শেষ করতে।
তিনি আরো জানান, গত বছর মেলা কমিটিকে ২৫ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। মেলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা সেমিনারে যে টাকা খরচ হয় সেটি আমরা বহন করবো। এবছর এখনো টাকার ব্যাপারে চুক্তি হয়নি।
মেলা উদযাপন কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোমিন উদ্দিন খান বলেন, ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ পর্যন্ত মেলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছি খুব শিগগিরই মেলার অনুমোদন পেয়ে যাব। ডিসেম্বরের ৮ তারিখ মেলার উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
৮০ লাখ টাকায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টকে মেলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ইভেন্টের কাছে মেলা বিক্রির কথা গুজব-ভিত্তিহীন। আমরা কোন টাকা নিয়ে মেলা ভাড়া দেইনি। গত বছর তাদের লোকসান হওয়াতে মানবিক কারনে পুনরায় তাদেরকে মেলার দায়িত্ব দিয়েছে। ইভেন্ট পরিচালনা কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন স্টেজে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মুক্তিযোদ্ধাদের গিফট ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শিল্পীদের ব্যয়ভার বহন করবে।
মেলায় অতিরিক্ত দামে দোকান বরাদ্দের বিষয়ে তিনি বলেন, এই বিষয়টি তার জানা নেই।
এব্যাপারে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতারের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সবখবর/ নিউজ ডেস্ক