পারভীন ও স্তন ক্যান্সার: যুদ্ধ জয়ের গল্প

Parvin

পারভীন বয়স ৩৫। দুই সন্তানের মা। মানিকগঞ্জ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিমছাম একটা গ্রামে বসবাস। সন্তান দুটো পড়াশুনা করে। জামাই হাসানুল এখন মুদি দোকান করে। অনেক কষ্ট হয়েছে দোকান টা করতে। অর্থকষ্ট আছে। কিন্তু সুখের কোন কমতি নেই।

কিছুদিন থেকে পারভীন খুব চিন্তিত। আজ থেকে প্রায় ছয়টা মাস হতে চলছে তার ডান দিকের স্তন এ একটা চাকা অনুভব করে। তখনি সে হাসানুল কে বিষয়টি জানায়। হাসানুল বউ অন্তপ্রান। অজানা আশংকায় সে আর দেরি না করে সরকারি হাসপাতালে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার সাহেব ভাল মত দেখে একটা পরিক্ষা করতে বলে। সুচ ফুটিয়ে একটা পরিক্ষা। মানিকগঞ্জ এ এই পরিক্ষা টা হয় না। দুরুদুরু বুকে হাসানুল বউ কে নিয়ে যায় সাভারের একটা ক্লিনিক এ। তারপর রিপোর্ট এর জন্য অপেক্ষা আর আল্লাহ কে ডাকা।

রিপোর্ট হাতে পেতে চারদিন লাগে। মাঝখানের এই সময়টা কিভাবে পার করেছে সেটা পারভীনের ভালই মনে আছে। রিপোর্ট হাতে পেলে হাসানুল এবার একাই সেই ডাক্তারের কাছে চলে যায়। পারভীন কে এবার ইচ্ছে করেই আনে নি। আল্লাহ না করুক যদি খারাপ কিছু হয় তাহলে সে কিভাবে তার আদরের বউটিকে সামাল দেবে। ডাক্তার সাহেব খাম থেকে রিপোর্ট টা বের করে পরছেন আর সেই সময়ে হাসানুল অজানা আশংকায় ঘেমে ভিজে যাচ্ছে। হৃদপিন্ড টাও যেন বুক থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে।

ডাক্তার সাহেবের কথায় হাসানুল এর বুক থেকে চেপে বসা সেই পাথর টা সরে গেল। জীবন এ এত খুসি হাসানুল কখনো হয় নি। না পারভীন এর স্তনে কোন কান্সার বাসা বাধে নাই। হাসানুল দেরি না করে সাথে সাথেই বউ কে ফোন দিয়ে জানাল সুসংবাদ টা। হাসানুল এর আফসোস হচ্ছে, সাথে পারভীন কে আনলেই ভাল হত। হাছানুলের ফোন পেয়ে নিজের অজান্তেই পারভীন এর দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে।

এরপর চারটা মাস ভালই কাটল। কিন্তু মাস খানেক হল পারভীন বুঝতে পারে তার সেই চাকা টা আগের থেকে অনেক বড় হচ্ছে। কোন ব্যাথা নেই।কিন্তু চাপ দিলে স্তন এর বোটা দিয়ে লাল পানির মত কি যেনো বের হয়ে আসে। আয়নার সামনে নিজের উপরের অংশ অনাবৃত করে পারভীন খেয়াল করে তার ডান স্তনটা বাম স্তনের চেয়ে একটু বেশি উপরে। স্তনের বোটা টাও কেমন যেনো উচ্চতা হারিয়ে ভিতরের দিকে ঢুকে গেছে। স্তনের চামড়া টা কেমন যেনো কমলার খোঁসার মত দেখতে লাগছে। ভয় পেয়ে যায় পারভীন। ভাল করে ধরে সে খেয়াল করে সেই চাকাটি অনেক শক্ত আর সেটা চামড়ার সাথে ফিক্সড হয়ে আছে। সে বুঝতে পারে বিষয়টা হাসানুলকে জানানো দরকার। সংসারের চাপে আর হয়ে উঠেনি।

মানিকগঞ্জে আছি বেশ কিছুদিন হলো। কিন্তু আমার বোহেমিয়ান মন টার জন্য এখনো সেই অর্থে প্র্যাকটিস করা টা হয়ে উঠেনি।চেম্বারে রোগী নেই। চলে যাবার মুহূর্তে এক রোগীর আগমন। নাম জিজ্ঞেস করতেই সংগে থাকা পুরুষটি তার স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বলে পারভীন। সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করতেই হাসানুল কতগুলি রিপোর্ট এগিয়ে দিতে চাইলে বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করে আগে রোগীর সমস্যা শুনলাম পরে প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিক্ষা করলাম। দেখলাম ডান স্তনে একটি কেন্দ্রীয় টিউমার যা স্তনের বোটা আর তার চারপাশের কালো অংশ জুড়ে বিস্তৃত। স্তন ক্যান্সারের অনেক লক্ষণের উপস্থিতি নিশ্চিত ভাবে বিদ্যমান। এবারে পূর্বের কাগজ দেখতে চাইলে FNAC রিপোর্ট এ চোখ আটকিয়ে গেল ।দেখলাম সেখানে ক্যান্সারের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

আমি এই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অপারেশন করতে রাজি না হয়ে পূণরায় FNAC পরিক্ষা টা করতে বললাম। রোগীকে ধৈর্য্য সহকারে সময় নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা আর পুথিগত বিদ্যার আলোকে কাউন্সিলিং করলাম। কাউন্সিলিং একটা আর্ট যার প্রতি আমরা অনেক সময়ই উদাসীন থাকি।অথচ রোগীর বিশ্বাস অর্জন ও তার সঠিক চিকিৎসার জন্য যার গুরুত্ব অপরিসীম।
সাত দিন পরে আমার চেম্বারে হাসানুল আর পারভীন। বেশ হাসিখুশি মনে হলো। নিজ থেকেই বলল স্যার এবারে ও রিপোর্ট ভালো। ক্যান্সার পাওয়া যায়নি। আমি দেখলাম সেই রিপোর্ট। হাসানুল সত্য বলছে। এবার বেশ জোর দিয়ে বললাম আমি এবারেও এই রিপোর্ট বিশ্বাস করছি না। তোমাকে আবারও ঢাকা যেয়ে Tru cut Biopsy করতে হবে। যদি একশ বার রিপোর্ট নেগেটিভ আসে তখনো আমি বিশ্বাস করতে পারব না। আরেকটা উপায় ছিল। সেটা হলো Open biopsy করা। কিন্তু কেন্দ্রীয় টিউমার এ এটা করা বেশ ঝামেলা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস দেখে রোগী ফের পরিক্ষা করাতে রাজী হলো। আমিও খুব বিব্রত হচ্ছিলাম রোগীর হয়রানির জন্য।

সাতদিন পরের ঘটনা। রোগী ও তার আত্মীয় স্বজনেরা ভীড় আমার চেম্বার এ। তদের বক্তব্য তারা পরিক্ষাটি করতে ঢাকা গিয়েছিল। সেখানে তারা সেটা না করে Open Biopsy করতে বলে। এতে যে খরচের হিসাব তারা দেয় তা তাদের ক্ষমতার বাহিরে।

হাসানুল এইবার সরাসরি আমাকে জিজ্ঞাসা করে, জানতে চায় Tru cut Biopsy তে যদি রিপোর্ট নেগেটিভ আসে তখন আপনি কি আপনার মত পরিবর্তন করবেন। আমি বললাম তখনও আমি এটাকে কান্সার বলব। হাসানুল বলে, আমার স্ত্রী। আমি বলছি আপনি কান্সার এর অপারেশন টাই করে দেন। আমি বললাম হাতে নিশ্চিত প্রমান না থাকলে আমি এটা করতে পারব না। এবার হাসানুল বলে তাহলে আর আমার পক্ষে এই চিকিতসা আর কখনোই করানো সম্ভব না। আমরা বাসায় ফিরে যাব।

জীবন বরই বিচিত্র। আমি গভীর ভাবে চিন্তা করলাম। একটা কেন্দ্রীয় টিউমার এর রিপোর্ট যদি নেগেটিভ ও আসে তারপরেও সেটা অপসারণ করতে হবে। অপসারণের পর ডান স্তনের খুব অল্প অংশই অবশিষ্ট থাকবে যেখানে ইম্প্লানট নয়ত রিকন্সট্রাক্টিভ সার্জারী লাগবে। যেটা তাদের পক্ষে কখনো করানো সম্ভব না।

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমি ক্যান্সার এর সার্জারীটাই করব। নিয়মের বাহিরে গিয়েই করব।মনে মনে ভাবলাম আমার ঔদ্ধত্যের লাগাম পড়ানোর সময় আসন্ন। যত্ন নিয়ে অপারেশন টা শেষ করলাম। সাতদিন পর রিপোর্ট আসল। পারভীন এর ক্যান্সার হয়েছে। সার্জারীটা অসাধারণ হয়েছে। রিপোর্ট বলছে ক্যান্সার টি সম্পূর্ণ ভাবে অপসারণ করা গেছে। মোট ৩১ টা লিম্ফ নোড অপসারণ করা হয়েছে। বিশ্বের ডেডিকেটেড ক্যান্সার হাসপাতালেও যা করা কষ্টসাধ্য।

পারভীন আর হাসানুলের জন্য মন খারাপ লাগছে। বললাম ক্যান্সার টি সনাক্ত করা গেছে, সেটা সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে। এখন বাকী চিকিৎসা গুলো নিয়ম মত সম্পন্ন করলে একজন সুস্থ মানুষের মত আয়ু নিয়ে জীবন যাপন করতে পারবে!

লেখক: ডা: মো: আরিফুর রহমান, এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য) এফসিপিএস (সার্জারী), বিশেষজ্ঞ জেনারেল ও ল্যাপারস্কপিক সার্জন, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ। চেম্বার: মেডিল্যাব জেনারেল হাসপাতাল, বাসস্ট্যান্ড, মানিকগঞ্জ।

নিউজটি শেয়ার করুন
Scroll to Top