বি.এম খোরশেদ
সাংবাদিকতার নামে প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলে অভিযোগ নতুন নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মানিকগঞ্জে তা যেন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কিছু অসাধু ব্যক্তি এখন সাংবাদিক পরিচয়কে ঢাল বানিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের ওপর বেপরোয়াভাবে অত্যাচার চালাচ্ছে। নিজেদের হাতে একটি নামমাত্র পত্রিকা বা অনলাইন নিউজপোর্টালের আইডি কার্ড, পকেটে একটি মোবাইল ফোন-এই সামান্য অস্ত্রেই তারা আজ সমাজে আতঙ্কের অন্য নাম হয়ে উঠেছে।
এরা কেউই সাংবাদিকতার পেশাগত মানদন্ডে পড়েন না। সংবাদ সংগ্রহ, যাচাই, সম্পাদনা বা প্রকাশ-কোনোটিই এদের কাজ নয়। ফেসবুক পেজ বা ইউটিউব চ্যানেলই তাদের মূল প্লাটফর্ম। সেখানে তারা নিজেদের প্রচারণা চালায়, ভিডিও বানায়, এবং প্রয়োজনে যে কাউকে “এক্সপোজ” করার হুমকি দিয়ে অর্থ আদায়ের ফাঁদে ফেলে। প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা কিংবা প্রকৃত সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ভান করে নিজেদের প্রভাবশালী হিসেবে উপস্থাপন করে। অথচ তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য-চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইল।
মানিকগঞ্জ শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকা, বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিক, আবাসিক হোটেল, ভূমি অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, পাসপোর্ট অফিস, বিআরটিএ অফিস, ইউনিয়ন পরিষদসহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন এই ভুয়া সাংবাদিকদের অবাধ বিচরণ। যেখানে সামান্য কোনো ঘটনা ঘটে, সেখানেই হাজির হয় তারা। ভেকু বা ড্রেজার দিয়ে মাটি কাটা, স্থানীয় বিরোধ, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, আত্মহত্যা, মারামারি কিংবা পরকীয়ার অভিযোগ-সবকিছুতেই তারা ‘সংবাদ’ খুঁজে বের করে। ক্যামেরা হাতে গিয়ে ভিডিও করে, তারপর সেটিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের ভয় দেখিয়ে নানা পক্ষ থেকে অর্থ আদায়ের চেষ্টা চালায়।
অধিকাংশ সময় এদের বেপরোয়া আচরণ ও দায়িত্বহীন ভিডিও প্রকাশের কারণে এলাকায় বিরোধ আরও জটিল আকার ধারণ করে। সংবেদনশীল বিষয়, বিশেষ করে নারী ও শিশুকে নিয়ে সংবাদ বা ভিডিও প্রকাশে এরা কোনো নৈতিকতা বা সংযমের পরিচয় দেয় না। ফলে ভুক্তভোগীরা পড়েন মানসিক, সামাজিক ও পারিবারিক সংকটে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাদের এই তথাকথিত “সংবাদ” এলাকার শান্তি বিঘিœত করে এবং মানুষের ব্যক্তিগত মর্যাদা ক্ষুণ করে।
দিনভর ঘুরে ঘুরে মানুষের কাজের ফাঁকে ভয় দেখিয়ে, ‘সংবাদ প্রকাশের’ নামে অর্থ দাবি করে তারা। অনেক সময় তাদের কথাবার্তায় এমন আত্মবিশ্বাস দেখা যায় যে, সাধারণ মানুষ সত্যি মনে করে বসে-এরা হয়তো ক্ষমতাসীন কারও ঘনিষ্ঠ। ফলে ভয়ে বা হয়রানির আশঙ্কায় অনেকেই টাকা দিয়ে রেহাই পান।
অন্যদিকে প্রকৃত সাংবাদিকরা সারাদিন ছুটে চলেন খবরের পেছনে। তথ্য যাচাই ও সম্পাদনায়। তাদের পেশা কঠোর নীতি, দায়িত্ব ও সময়নিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এই ভুয়া সাংবাদিকদের কারণে পেশাদারদের সুনাম ও মর্যাদা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যেও একধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে-‘কে আসল, কে নকল’ তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই পরিস্থিতি অবসানে এখনই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।প্রথমত, প্রশাসনকে কঠোরভাবে এসব ভুয়া সাংবাদিকদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, পেশাদার সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে তাদের সদস্য তালিকা সুশৃঙ্খল ও যাচাইকৃত রাখতে হবে। যেন কেউ অবৈধভাবে সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করতে না পারে। তৃতীয়ত, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে নিজেদের নৈতিক অবস্থান শক্ত করা-কারণ নৈতিক দুর্বলতার সুযোগেই জন্ম নেয় এই ছদ্মবেশী প্রতারকরা।
সাংবাদিকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি একটি প্রতিশ্রæতি-সত্য, ন্যয় ও মানবতার পক্ষে অবস্থানের প্রতিশ্রুতি।কিন্তু এই পবিত্র দায়িত্বের আড়ালে যখন অসাধু চক্র স্বার্থ হাসিলের ফাঁদ পাতছে, তখন শুধু সমাজ নয়, সাংবাদিকতাও আক্রান্ত হচ্ছে।
এখন সময় এসেছে-মানিকগঞ্জসহ সারাদেশে সাংবাদিকতার নামে চলা এই প্রতারণার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার। অন্যথায়, ধীরে ধীরে মানুষ হারাবে সংবাদমাধ্যমের প্রতি আস্থা, এবং গণমাধ্যম হারাবে তার সামাজিক দায়িত্ববোধের শক্ত ভিত্তি।
লেখকঃ সিনিয়র স্টাফ করেসপনডেন্ট, যমুনা টেলিভিশন, মানিকগঞ্জ।