দেলোয়ারের প্রাকৃতিক কৃষিকেন্দ্র ও প্রাণবৈচিত্র্য খামার

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের কাউটিয়া গ্রামে অবস্থিত একটি খামার বাড়ি, যেখানে প্রকৃতি ও কৃষির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি উদাহরণ। দেলোয়ার জাহান নামক একজন শিক্ষিত কৃষক এই খামারটির প্রতিষ্ঠাতা, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘প্রাকৃতিক কৃষিকেন্দ্র ও প্রাণবৈচিত্র্য খামার’। বিলাসী জীবন থেকে সরে এসে প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষার লক্ষ্যে দেলোয়ার গড়ে তুলেছেন এই খামার, যা তার গভীর আগ্রহের প্রতিফলন।

খামারে উৎপাদিত প্রতিটি ফসল এবং সবজি কীটনাশক ও রাসায়নিক সারমুক্ত। খামারের পরিবেশও বেশ ভিন্ন; এখানে সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এবং মাটির তৈরি পাত্রেই খাওয়া-দাওয়া হয়। দেলোয়ারের খামারের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছে সবুজ প্রকৃতি, যেখানে পাখির কিচিরমিচির শব্দ পরিবেশকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে।

কুষ্টিয়ার গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী দেলোয়ার জাহান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। সিঙ্গাপুরে চাকরির প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও, তিনি তার শখ ও আবেগের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। ছোটবেলা থেকেই কৃষি ও প্রকৃতির প্রতি তার গভীর আকর্ষণ ছিল, যা তাকে এই পথের দিকে নিয়ে আসে।

ঢাকায় ৮ বছর সাংবাদিকতা করার পর, বিশেষত কৃষি ও পরিবেশ বিষয়ে কাজ করার সময় দেলোয়ারের মনে আরও এক গভীর চিন্তা জন্ম নেয়। তিনি উপলব্ধি করেন, আধুনিক কৃষিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যাপক ব্যবহার প্রকৃতি এবং মানবজাতির জন্য বিপদ ডেকে আনছে। তাই তিনি চিন্তা করেন নিরাপদ খাদ্য এবং বিশুদ্ধ অক্সিজেনের গুরুত্ব নিয়ে কাজ করবেন।

২০০৪ সালে দেলোয়ার তার চিন্তা শেয়ার করেন কয়েকজন সমমনাদের সঙ্গে, এবং ২০১২ সালে তিনি মানিকগঞ্জের কাউটিয়া গ্রামে একটি খামার প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের কেনা দুই বিঘা জমি এবং স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে লিজ নিয়ে ১৪ বিঘা জমিতে উৎপাদন করেন কীটনাশক-মুক্ত ফসল। তার খামারে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি এবং মাছও বড় হচ্ছে প্রাকৃতিক খাদ্যে।

দেলোয়ার বলেন, “আধুনিক চাষাবাদে কীটনাশকের ব্যবহারে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। প্রকৃতিতে এমন অনেক উপাদান রয়েছে, যেমন পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণকারী প্রাণী, যা কীটনাশক ছাড়াই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম।”

আজ তার খামারে প্রতিদিনই শিক্ষার্থী, কৃষক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আগত মানুষ প্রাকৃতিক কৃষি বিষয়ে শিক্ষা নিতে আসেন। তিনি তাদের শেখান কীভাবে নিরাপদ খাদ্য ও বিশুদ্ধ অক্সিজেনের মাধ্যমে জীবনযাত্রা উন্নত করা সম্ভব।

দেলোয়ারের উদ্যোগটি শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়। তার খামারের প্রভাব টাঙ্গাইল, সুনামগঞ্জ, ঝিনাইদহসহ অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি একটি প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্রও চালু করেছেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে, যেখানে খামারের ফসল বিক্রয় হয়।

দেলোয়ার নিজেকে একজন কৃষক হিসেবেই পরিচয় দেন, যদিও তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেক। তার স্ত্রী ডলি বেগমও খামারের কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করেন। তাদের দুই সন্তান, তৃণ এবং ভূমি, ভবিষ্যতে প্রকৃতির প্রতি সচেতনতা এবং সচেতন কৃষির সঙ্গে পরিচিত হবে বলে দেলোয়ার আশা করেন।

তিনি আরও বলেন, “প্রাকৃতিক কৃষির প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু বাণিজ্যিক চাপের কারণে অনেকেই সফল হতে পারেন না। আমি আশা করি, ভবিষ্যতে আমার খামারটি একটি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে, যেখানে মানুষ প্রাকৃতিক কৃষি শিখে একটি স্বনির্ভর সমাজ গড়ে তুলবে।”

নিউজটি শেয়ার করুন
Scroll to Top